রাজধানীর শনির আখড়া এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করেন রোজিনা আক্তার। স্বামী আর আড়াই বছরের একমাত্র ছেলে অয়নকে নিয়েই তার পরিবার। গত ১৮ জুলাই হঠাৎ করেই নাড়ীছেড়া ধন নয়ন জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। প্রাথমিকভাবে প্যারাসিটামল খাওয়ালেও কোনো কাজ হয়নি। বরং গুরুতর অসুস্থ হয়ে বমি ও পায়খানা করতে থাকে রোজিনার একমাত্র ছেলে। এতে পরিবারের সদস্যরা দুশ্চিন্তায় পড়ে যান।

এ পরিস্থিতিতে ঈদের দিন (২১ জুলাই) ঢাকা শিশু হাসপাতালে শিশু অয়নকে ভর্তি করা হয়। পরে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ডেঙ্গু ধরা পড়ে। সেদিন থেকেই হাসপাতালের ১ নম্বর ওয়ার্ডে অয়নের চিকিৎসা চলছে।
ছেলের অসুস্থতার বিষয়ে রোজিনা আক্তার বলেন, ‘আমার বাড়ির ভেতরে পরিষ্কার থাকলেও এলাকার চারপাশে ময়লা আবর্জনায় ভর্তি। নিয়মিত সেসব পরিষ্কার করা হয় না। ফলে সেখানে মশা জন্ম নিচ্ছে। এ কারণে এলাকার অনেকে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন বলে শুনছি।’
তিনি বলেন, ‘১৮ জুলাই হঠাৎ করে অয়নের জ্বর আসে। প্রাথমিকভাবে ফার্মেসি থেকে প্যারাসিটামল এনে খাওয়াই কিন্তু জ্বর কমেনি। উল্টো অয়ন আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। এক পর্যয়ে কালো বমি ও পায়খানা করতে থাকে। এতে আমরা ভীষণ ঘাবড়ে যাই। দ্রুত বেসরকারি একটি হাসপাতালে ও ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাই। কিন্তু কেউ ভর্তি নেয়নি। তারপর ঈদের দিন রাতে এখানে নিয়ে আসি। পরীক্ষা করে ডেঙ্গু ধরা পড়ে।’
তিনি আরও বলেন, ‘জ্বর আসার পর অয়ন কিছুই খেতে চাইতো না। কথা বলতো না। সারাক্ষণ বিছানাই শুয়ে থাকতো। তেমন নড়াচড়া করতোও না। এই হাসপাতালের চিকিৎসায় বর্তমানে আমার বুকের মানিক এখন কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠেছে।’
অয়নের মতো বিভিন্ন বয়সের আরও ৩৮ শিশু ঢাকা শিশু হাসপাতালে ডেঙ্গ জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বর্তমানে চিকিৎসা নিচ্ছে।
সোমবার (২৬ জুলাই) সরেজমিন হাসপাতালটি ঘুরে দেখা গেছে, করোনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রতিনিয়ত ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। গড়ে প্রতিদিন এ হাসপাতালে পাঁচ জন শিশু ভর্তি হচ্ছে। গত এক বছরে যেখানে মাত্র ৬৫ জন শিশু এ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল সেখানে গত দুই মাসেই ৬৫ জন ভর্তি হয়েছে। তাদের মধ্যে গুরুতর অবস্থা হওয়ায় চার জনকে আইসিইউতে ভর্তি রাখা হয়েছে। গত এক সপ্তাহে ডেঙ্গু আক্রান্ত দুইজন শিশু মারা গেছে বলে জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
দেখা গেছে, ঢাকা শিশু হাসপাতালে আলাদাভাবে ডেঙ্গু ওয়ার্ড তৈরি না কারায় বিভিন্ন স্থানে ডেঙ্গু আক্রান্তদের রাখা হচ্ছে। হাসপাতালের নিচতলায় কথা হয় রাজধানীর মেরুল বাড্ডার বাসিন্দা দূর্গা রানী হালদারের সঙ্গে। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়ায় ১২ বছরের মেয়ে দেবী রানী ও পাঁচ বছরের ছেলে ওম হালদারকে হাসপাতালে ভর্তি করেছেন।
দূর্গা রানী বলেন, ‘গত ২১ জুলাই দুপুরে মেয়ের জ্বর আসে। এর ১২ ঘণ্টা পর ছেলেরও জ্বর আসে। পরদিন পাশেই মা ও শিশু কেন্দ্রে নিয়ে গেলে ডাক্তার কিছু ওষুধ দেয়। সেসব খেয়ে সুস্থ না হওয়ায় আবার সেখানে গেলে ডেঙ্গুসহ বেশ কয়েকটি পরীক্ষা করতে দেয়। পরীক্ষার ফলাফলে ডেঙ্গু শনাক্ত হলে প্রথমে মা ও শিশু কেন্দ্রে ভর্তি করাই। সেখানে সকল সুবিধা না থাকায় সেদিন রাতে ঢাকা শিশু হাসতাপালে ছেলে ও মেয়েকে আনলে চিকিৎসকদের পরামর্শে তাদের ভর্তি করাই।’
তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী কাঠের কাজ করেন। তার আয় দিয়ে পরিবার চলে। বাড্ডায় একটি ফ্ল্যাট বাড়িতে ভাড়ায় থাকি। সবসময় বাড়ির ভেতরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখায় বাসায় ভেতরে মশা নেই। বাড়ির চারপাশে বিভিন্ন স্থানে আর্বজনা ভর্তি হয়ে পড়ে থাকে। ছেলেমেয়েরা বাইরে খেলতে গিয়ে মশার কামড়ে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে।’
তিনি জানান, তার ছেলে-মেয়ের চিকিৎসা করতে এ পর্যন্ত ৪০ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। আরও কত ব্যয় হবে তা তিনি বলতে পারছেন না।
পাশেই ১৬ মাসের শিশু সাবিহাকে নিয়ে হাসপাতালে বেড়ে মশারি ঝুলিয়ে বসে রয়েছেন কল্যাণপুরের বাসিন্দা মনোয়ারা বেগম। গত ২১ আগস্ট রাতে তার সন্তানের জ্বর আসে। গত শুক্রবার একটি বেসরকারি হাসপতালে নিয়ে ডাক্তার দেখালে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। শনিবার দুপুরে সাবিহাকে ঢাকা শিশু হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। বর্তমানে তার চিকিৎসা চলছে।
এমন অনেক শিশুকেই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালের বেড়ে শুয়ে কাতরাতে দেখা গেছে।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. প্রবীর কুমার সরকার বলেন, ‘গত দুই মাস ধরে ব্যাপকভাবে শিশুরা ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছে। বর্তমানে এটি ভয়াভয় আকার ধারণ করছে। স্বাস্থ্যবান ও বেশি ওজনের শিশুদের বেশি গুরুতর অবস্থা তৈরি হচ্ছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে এটি রোধ করা সম্ভব না হলে ঘরে ঘরে এটি ছড়িয়ে পড়তে পারে।’
তিনি বলেন, ‘গত দুই মাসে আমাদের এখানে ৬৫ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছে। বর্তমানে ৩৮ জনের চিকিৎসা চলছে। এর মধ্যে গত সপ্তাহে দুই শিশু মারা গেছে।’
ডা. প্রবীর কুমার আরও বলেন, ‘স্কুলগামী শিশুরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। ডেঙ্গু রোগীদের জন্য ২০ সিটের আলাদা একটি ওয়ার্ড তৈরি করা হচ্ছে।’
এই চিকিৎসক পরামর্শ হিসেবে বলেন, ‘সবাইকে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। ঘরের ভেতরে ও বাইরে মশা নিয়ন্ত্রণে ওষুধ বা স্প্রে ব্যবহার করা যেতে পারে।’ কারও শরীলে ডেঙ্গুর উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত সময়ের মধ্যে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।