আব্দুস সামাদ, সাতক্ষীরা প্রতিনধি: ১২ বছর বিদেশে থেকে দেশের অর্থনীতিতে অনেক অবদান রেখেছেন। তিন মাসের ছুটিতে ২০২০ সালের মার্চ মাসে দেশে এসেছেন। ছুটি শেষে ফিরে যাওয়ার জন্যও নিয়েছিলেন ফিরতি বিমানের টিকিট। জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে ফিরে যাবেন নিজ কর্মস্থলে। আবারও দেশের জন্য পাঠাবেন বৈদেশিক মুদ্রা। কিন্তু চলমান করোনা মহামারীতের কাজ না থাকা, দেশ ভিত্তিক লকডাউন, চাহিদা মাফিক টিকা গ্রহণসহ নানা জটিলতায় আর কর্মস্থালে যেতে পারেনি জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার নলতা গ্রামের রেমিট্যান্স যোদ্ধা মনিরুল ইসলাম।

মালয়েশিয়া থেকে আসা মনিরুল ইসলাম দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলেন, বিদেশে থেকে অর্থ উপার্যন করে দেশের অর্থনীতি আমরা সব সময় অবদার রাখি। কিন্তু আজ আমাদের বিপদের সময় কেউ আমাদের খোজ রাখে না। প্রায় দেড় বছর হয়েছে দেশে এসেছি। ছুটিতে আসার সময় যে টাকা নিয়ে এসেছিলাম সেই টাকায় কোন ভাবে বাড়ির কাজ করেছি। ছুটি শেষে কর্মস্থলে ফিরতে না পারার কারণে বর্তমানে মানবেতন জীবন যাপন করছি।
তিনি আরও বলেন, মা, বোন, ছেলে, মেয়ে ও স্ত্রী নিয়ে ৬ জনের সংসার। বর্তমানে মা খুবই অসুস্থ। প্রতি মাসে মায়ের জন্য ওষুধ কিনতে হয়। বেকার জীবনে সকলকে নিয়ে জীবন যাপন করা এখন কঠিন হয়ে পড়েছে।
তিনি আরও বলেন, সরকার আমাদের সহযোগীতা করবেন শুনে জেলায় কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসে যেয়ে অনলাইনে নাম রেজিষ্ট্রেশন করেছি। সুনেছি জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে সরকার আমাদের প্রণোদনা দেবেন। কিন্তু আজও পর্যন্ত কোন প্রণোদনা পেলামনা।
তিনি আরও বলেন, ব্যবসা করার জন্য যে অর্থের প্রয়োজন তা আমার নাই। তাই ঋণ গ্রহণের জন্য প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক সাতক্ষীরা শাখায় গিয়েছিলাম। কিন্তু ব্যাংক গ্রান্টার চায়। বেকার হওয়ার কারণে আমার পক্ষে কেউ গ্রান্টার হতে রাজি না হওয়ায় ঋণও পাচ্ছি না। সব মিলিয়ে বর্তমানে পরিবার নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় আছি।
করোনায় কর্মহীন হয়ে সিঙ্গাপুর থেকে ফেরত এসেছেন তালা উপজেলার সরুলিয়া ইউনিয়নের ভারষা গ্রামের আর এক রেমিট্যান্স যোদ্ধা ইকবাল হোসেন। তিনি জানান, সাড়ে নয় লক্ষ টাকা খরচ করে গিয়েছিলেন সিঙ্গাপুর। কিন্তু করোনার কারনে ২০২০ সালের মার্চ মাসে দেশে ফেরত এসেছেন। ৬ বছর সিঙ্গাপুর থেকে তিনি খরচের টাকাও তুলতে পারেননি। বর্তমানে কর্মহীন হয়ে প্রায় দেড় বছর মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
তিনি আরও জানান, যে টাকা খরচ করে সিঙ্গাপুর গিয়েছিলাম সেই টাকা তিনি তুলতে পারেননি। বর্তমানে নতুন কোন ব্যবসা করবেন সে টাকাও নেই।
সরকারিভাবে কোন সহযোগীতা তিনি পাননি উল্লেখ করে আরও জানান, আমরা পরিবার ফেলে বিদেশে যেয়ে দেশের জন্য টাকা পাঠাই। সেই টাকায় দেশের উন্নয়ন হয়। দেশের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে আমার দিন-রাত পরিশ্রম করি। কিন্তু আমাদের মত রেমিট্যান্স যোদ্ধারা যখন বিপদে পড়ে তখন কেউ আমাদের পাশে এসে দাড়ায় না।
করোনা মহামারীতের কর্মহীন হয়ে দেশে ফেরত আসা জেলার প্রায় সাড়ে ৪শ রেমিট্যান্স যোদ্ধা আজ মানবেতন জীবন যাপন করছে। সরকারিভাবে এসব রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের এককালীন ১৩ হাজার ৫০০ টাকা করে দেওয়া এবং তাদের ডেটাবেজ তৈরি সংক্রান্ত একটি ৪২৭ কোটি টাকার প্রকল্প পাশের জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় এ হিসেব একনেক সভায় দিয়ে। গত ২৮ জুলাই পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য শরিফা খান সংবাদ সম্মেলনের এ তথ্য দেন। কিন্তু জেলার রেমিট্যান্স যোদ্ধারা অনলাইনে রেজিষ্ট্রেশন করলে আজও পর্যন্ত কোন সরকারি প্রণোদনা আওতায় আসেনি।
জেলায় কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিস থেকে জানা যায়, করোনা মহামারীর কারণে ২০২০ সালের মার্চ থেকে অদ্যবধি জেলায় চারশ ৫৭ জন রেমিট্যান্স যোদ্ধা কর্মহীন হয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। ফিরে আসা এসব রেমিট্যান্স যোদ্ধার অধিকাংশই মালয়েশিয়া থেকে এসেছেন। জেলায় ফেরত আসা এসব রেমিট্যান্স যোদ্ধার মধ্যে কলারোয়া উপজেলায় সব চেয়ে বেশি কর্মহীন হয়ে ফেরত এসেছেন। কর্মহীন হয়ে ফেরত আসা চারশ ৫৭ জন রেমিট্যান্স যোদ্ধার মধ্যে শুধু কলারোয়া উপজেলায় ফেরত এসেছেন দুইশ ৯৪ জন। সাতক্ষীরা সদর উপজেলায় ফেরত এসেছেন একশ আট জন, তালা উপজেলায় ফেরত এসেছেন ২৩ জন, কালিগঞ্জ উপজেলায় ফেরত এসেছেন ২৩ জন, শ্যামনগর উপজেলায় ফেরত এসেছেন ছয় জন, আশাশুনি উপজেলায় ফেরত এসেছেন দুই জন এবং দেবহাটায় উপজেলায় ফেরত এসেছেন এক জন। এছাড়াও ভারত থেকে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ফেরত এসেছেন ৪৬ জন।
এ অফিস থেকে আরও জানা যায়, জেলার প্রায় ৪০ হাজার রেমিট্যান্স যোদ্ধা কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশে অভিবাসন করেছে। বাংলাদেশের অভিবাসী শ্রমিকরা মূলত বিভিন্ন ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের স্বল্প মেয়াদি চুক্তিভিত্তিক কর্মী, তাই এদের অনেকেই চুক্তি শেষে দেশে ফিরে এসেছেন। অনেকে ছুটিতে এসে বিভিন্ন জটিলতায় আর কর্মস্থলে ফিরতে পারেননি।
প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক সাতক্ষীরা শাখার সিনিয়র এক্সিকিউটিভ অফিসার চয়ন কুমার হালদার বলেন, বিদেশ থেকে যারা দেশে ফিরে আসছে তাদের জন্য আমরা সহজ শর্তে ঋণ দিচ্ছি। যে ঋণ গ্রহণ করে তারা গরুর খামার, হাস-মুরগির খামার, মৎস্য চাষ, ওষুধের দোকানসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায় নিজেকে নিযুক্ত করতে পারেন।
তিনি আরও বলেন শুধু বিধে ফেরত নয়, যারা বিদেশে যেতে চায় তাদের আমরা ঋণ দিয়ে থাকি। এমনকি পরিবারের জন্য ঋণ দিচ্ছে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক।
তিনি আরও বলেন, সাতক্ষীরা শাখা থেকে এ পর্যন্ত একশ ১৯ জন দেশে ফেরত আসা কর্মহীন রেমিট্যান্স যোদ্ধাকে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। এই ঋণ সুবিধা নিয়ে বর্তমানে তারা নতুন নতুন ব্যবসায় যুক্ত হয়ে ভালো ভাবে জীবন যাপন করছে।
জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসের সহকারী পরিচালক মোস্তফা জামান বলেন, করোনাকালীন সময়ে যে সব রেমিট্যান্স যোদ্ধা কর্মহীন হয়ে দেশে ফিরে এসেছে তাদের তালিকা প্রস্তুত করে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে এবং প্রত্যেকের ডেটাবেজ অনলাইন করা হয়েছে। সরকারে বিষয়ে ভাবনা আছে দ্রুত সময়ের মধ্যে এদের বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত হবে বলে তিনি জানান।
সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির বলেন, করোনাকালীন সময়ে দেশে ফেরত আসা রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। তালিকা প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হবে। মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা আসার পর পরবর্তি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও তিনি জানান।